ইসলামের সাথে মাতৃভাষার সম্পর্ক

0 ১২৩

আহসানুল ইসলাম রাকি,

আমাদের হাসি-কান্না আর আনন্দ-বেদনা কিংবা বৈরিতা-মিত্রতা, আশা-হতাশার সবই প্রকাশ করে মাতৃভাষা। শিশুর প্রতি মায়ের তুলনাহীন স্নেহ, মায়ের প্রতি শিশুর অফুরন্ত ভালোবাসা প্রকাশ করে এই মাতৃভাষায়। পৃথিবীর প্রত্যেক জাত-বর্ণের লোক তাই মায়ের মতোই ভালোবাসে তার মাতৃভাষাকে।

নিপুণ শিল্পকুশলতায় আল্লাহ যেমন অপরূপ সৌন্দর্যের আধার তেমনি মানুষকে সৃষ্টি করেছেন নানা বৈচিত্র্য ও সৌন্দর্যের প্রতীক বানিয়ে। আল্লাহ তায়ালা মানুষকে বাকশক্তি দিয়েছেন, যা অন্য কোনো প্রাণীকে দেননি। ভাষার সুনিপুণ বৈচিত্র্য আর অনুপম বাক প্রতিভার মাধ্যমে জ্ঞানার্জন এবং জ্ঞান দানের শক্তি দিয়ে অন্য সব সৃষ্টি থেকে শ্রেষ্ঠ করা হয়েছে মানুষকে। ভাষা ও রঙের এই বিভিন্নতা সুপরিকল্পিত, যার পশ্চাতে পরিকল্পনাকারীর অস্তিত্ব বিদ্যমান। আকাশমালা ও বিশ্বজগৎ সেই পরিকল্পনাকারীর সৃষ্টি। ভাষা ও বর্ণের পার্থক্যও তার শ্রেষ্ঠ সৃষ্টির অন্যতম। বর্ণ ও ভাষার বিভিন্নতার ফলে বিভিন্ন সভ্যতা ও সংস্কৃতির আগমন-নির্গমন ঘটে চলেছে। কিন্তু তবুও এই বিভিন্নতার অন্তরালে স্থায়ীভাবে প্রবহমান রয়েছে একটি বিশাল একতা ও মানবতার ঐক্য। সব ভাষাকে সম্মান করা ইসলামের অনুপম শিক্ষা। কারণ, সব ভাষাই মহান স্রষ্টার শ্রেষ্ঠত্ব ও তার কুদরতের নিদর্শন। আল্লাহ তায়ালা পবিত্র কুরআনে ইরশাদ করছেন- ‘আর তাঁর নিদর্শনাবলির মধ্যে রয়েছে আকাশমণ্ডলী ও পৃথিবীর সৃষ্টি এবং তোমাদের ভাষা ও বর্ণের বৈচিত্র্য। এতে জ্ঞানীদের জন্য অবশ্যই বহু নিদর্শন রয়েছে।’ (সূরা রুম-২২)
প্রত্যেক জাতির কাছে তাদের স্বীয় মাতৃভাষার মর্যাদা যেমন অপরিসীম তেমনি আল্লাহ তায়ালার কাছে কোনো ভাষাই ছোট নয়। তিনি সব ভাষা জানেন, বোঝেন। যে যেভাবেই তাকে ডাকে না কেন তিনি বোঝেন, উত্তর দেন।

পবিত্র কুরআনে আল্লাহ তায়ালা ইরশাদ করছেন- ‘আর আমি প্রত্যেক রাসূলকে তার জাতির ভাষাতেই ওহিসহ পাঠিয়েছি, যাতে করে সে স্পষ্টভাবে আমার কথা তাদের বুঝিয়ে দিতে পারে।’ (সূরা ইবরাহিম-৪)

আল্লাহ তায়ালা অন্যত্র ইরশাদ করছেন- ‘তিনিই শিক্ষা দিয়েছেন কুরআন, তিনিই সৃষ্টি করেছেন মানুষ, তিনি তাকে শিক্ষা দিয়েছেন ভাষা।’ (সূরা আর রাহমান, আয়াত : ২-৪)

ভাষা হচ্ছে মানুষের ভাববিনিময় ও প্রকাশের প্রতীকী প্রত্যয় বিশেষ। এটি ধ্বনি ও ইশারা এবং ইঙ্গিত উভয়কে অন্তর্ভুক্ত করে। তবে পারিভাষিক অর্থে কারো কণ্ঠনিঃসৃত অর্থবোধক ধ্বনিকেই ভাষা নামে অভিহিত করা হয়।

ইসলাম সবসময় সমাজের প্রচলিত ইতিহাস, ঐতিহ্য ও সংস্কৃতিকে বারবার সম্মান জানিয়ে এসেছে। রাসূল সা: তার জীবনে আরবদের অনেক প্রচলনকে স্বীকৃতি দিয়েছেন যদি তা তাওহিদের পরিপন্থী ও মানুষের জন্য অকল্যাণকর না হয়ে থাকে। মাতৃভাষা যেকোনো দেশের ও সমাজের প্রচলিত ভাষা হতে পারে। ইসলাম সব কাজ ও যোগাযোগ মাতৃভাষায় করার জন্য গুরুত্বারোপ করেছে। সব ভাষাই মহান আল্লাহর সৃষ্টি। তাই কোনো ভাষাকেই অবজ্ঞা করার সুযোগ নেই। প্রত্যেক ভাষাই সম্মান ও মর্যাদাপ্রাপ্তির দাবি রাখে। ভাষা সৃষ্টি বৈচিত্র্য করার মধ্য দিয়ে মহান আল্লাহর মহাত্ম্য প্রকাশিত হয়।

মাতৃভাষা চর্চায় ইসলামের নির্দেশনা : মাতৃভাষার বিশুদ্ধ ব্যবহার, ভাষাশিক্ষা ও মাতৃভাষায় ইসলাম চর্চা করাকে বেশ গুরুত্ব দিয়েছে ইসলাম। যেসব গুণ মানুষের ব্যক্তিত্বকে অর্থবহ ও প্রশংসনীয় করে তোলে তার মধ্যে বিশুদ্ধ ভাষা এবং সুস্পষ্ট উচ্চারণ অন্যতম। আমাদের প্রিয় রাসূল হজরত মুহাম্মাদ সা: ছিলেন ‘আফছাহুল আরব’ তথা আরবের শ্রেষ্ঠ বিশুদ্ধভাষী। তাই বিশুদ্ধ মাতৃভাষায় কথা বলা নবী সা:-এর সুন্নত।

রাসূলুল্লাহ সা: সারা জীবনে নিজ মাতৃভাষায় একটি অশুদ্ধ বাক্যও উচ্চারণ করেননি; বরং অন্যদের মাতৃভাষা বিশুদ্ধভাবে শিক্ষার ব্যবস্থা করে দিয়েছেন এবং মাতৃভাষা চর্চার মাধ্যমে জ্ঞানের পথ উন্মুক্ত করেছেন। আবার কখনো কখনো তিনি যুদ্ধবন্দীদের ভবিষ্যৎ প্রজন্ম সন্তান-সন্ততিদের জন্য নিছক ভাষার শিক্ষক হিসেবে নিয়োগ দিয়ে, ভাষা শিক্ষা দেয়ার বিনিময়ে তাদের মুক্তও করে দিয়েছেন। (তাবাকাতে ইবন সাদ)

মহান আল্লাহ তায়ালা যুগে যুগে অসংখ্য নবী-রাসূলকে আসমানি কিতাবসহ স্বজাতির ভাষায় পৃথিবীতে পাঠিয়েছেন। যেমন হজরত দাউদ আ:-কে তার নিজ ভাষা গ্রিকে জবুর কিতাব নাজিল করেছেন। হজরত মুসা আ:-কে তাওরাত হিব্রু ভাষায়, হজরত ঈসা আ:-কে ইঞ্জিল সুরিয়ানি ভাষায়। শেষনবী হজরত মুহাম্মাদ সা:-এর ওপর পবিত্র কুরআনে কারিম নাজিল করেছেন আরবের ভাষা আরবিতে। এ প্রসঙ্গে আল্লাহ তায়ালা কুরআনে কারিমে ইরশাদ করছেন- ‘আমি প্রত্যেক নবীকে তাদের স্বজাতির ভাষায় প্রেরণ করেছি তাদের সম্প্রদায়ের কাছে, যাতে তারা জাতিকে সুস্পষ্ট ভাষায় বোঝাতে সক্ষম হয়।’ (সূরা মারইয়াম-৯৭)

ইসলাম প্রচার-প্রসার, দ্বীন ও জাতির খেদমতের অন্যতম একটি মাধ্যম হলো মাতৃভাষা। দাওয়াতে দ্বীনের অন্যতম কৌশলও হলো- বোধগম্য ভাষায় দাওয়াত উপস্থাপন করা। একজন মানুষের বড় গুণ হলো- তার মাতৃভাষায় যথার্থ পারদর্শিতা অর্জন করা। শুধু বছরে একবার শহীদ মিনারে ফুল দিয়ে ভাষাশহীদদের শ্রদ্ধা নিবেদন, কবর জিয়ারত ও দোয়ার পরিবর্তে খালি পায়ে দাঁড়িয়ে নীরবতা পালন এবং মাতৃভাষা দিবস এলেই ভাষা দিবসের আলোচনা সভা, বইমেলা ও আনুষ্ঠানিকতায় মহান মাতৃভাষাকে সীমাবদ্ধ করে রাখা ঠিক নয়; বরং প্রতিক্ষণ, সর্বক্ষেত্রে ব্যবহার করা নৈতিক দায়িত্ব।
ধর্মীয় দৃষ্টিকোণ থেকেও মাতৃভাষায় অনেক গুরুত্ব রয়েছে। কুরআন-হাদিস তথা ইসলাম প্রচারে মাতৃভাষার কোনো বিকল্প নেই। সে হিসেবে প্রত্যেক বাঙালি মুসলমান, বিশেষ করে আলেম-ওলামাদের কর্তব্য হলো- মাতৃভাষা চর্চায় মনোযোগী হওয়া।

বাংলা ভাষায় ইসলাম প্রচারের গুরুত্ব : ইসলামের সুমহান আদর্শকে বাংলাভাষী মানুষের কাছে পৌঁছে দিতে বাঙালি মুসলমানের বাংলা ভাষায় বুৎপত্তি অর্জনের বিকল্প নেই। আমাদের প্রিয়নবী হজরত মুহাম্মাদ সা: ছিলেন আরবের অধিবাসী তাই কুরআন অবতীর্ণ হয়েছে আরবি ভাষায়। পবিত্র কুরআনের বাণীগুলো ও রাসূলের হাদিসকে তাই বাংলা ভাষায় মানুষের কাছে পৌঁছে দিতে হবে এবং এটিই সময়ের অনিবার্য দাবি। কারণ আমাদের ভাষা আরবি নয়। কুরআন বোঝার স্বার্থে মুসলমানদের আরবি ভাষা জানা আবশ্যক হলেও আরবিভাষী না হওয়ার কারণে সবার পক্ষে তা জানা সম্ভব নয়। তাই কুরআন, হাদিস ও ইসলামী ফিকহ, তাফসির, বিধিবিধান ও ইসলামী সাহিত্যকে বাংলা ভাষায় এ দেশের মুসলমানদের হাতে পৌঁছে দিতে হবে।

বাংলাদেশের বেশির ভাগ মুসলমান ধর্মপ্রাণ; কিন্তু শুধু বাংলা ভাষায় ইসলাম ধর্মের সঠিক চেতনা তাদের কাছে পৌঁছে দেয়ার অভাবে তাদের অনেকেই ইসলামের সঠিক জ্ঞান রাখেন না। একসময় ফার্সি ভাষাকে অমুসলিমদের ভাষা মনে করা হতো। রুমি, জামি, শেখ শাদিরা সে ভাষায় অসংখ্য কবিতা, সাহিত্য রচনা করে ফার্সি ভাষাকে জয় করে ফেলেন। এতে ইসলামের বিশাল উপকার হয়। আল্লাহ ইকবাল উর্দু ভাষায় যে সাহিত্য রচনা করেছেন তা ইসলামী সাহিত্যকে সমৃদ্ধ করেছে। বাংলা ভাষায়ও আমাদের প্রিয়কবি কাজী নজরুল ইসলাম, ফররুখ আহমদ, গোলাম মোস্তফাসহ অনেকেই তাদের কবিতা ও সাহিত্যে ইসলামকে তুলে ধরেছেন। কিন্তু তা প্রয়োজনের তুলনায় নগণ্য। বর্তমানে আলেম-ওলামাদের অনেকেই লেখালেখি করেন; কিন্তু তা নির্দিষ্ট কিছু বিষয়ের ওপর। ইসলামের সব বিষয়, সব দিক ও অধ্যায় নিয়ে রচিত বইয়ের বাংলা অনুবাদ হলে, বাংলাভাষী মুসলমানরা ইসলামের আরো অনেক গুরুত্বপূর্ণ আলোচনা বুঝতে ও আমল করতে পারবে। বাংলা ভাষায় ইসলামের এসব গুরুত্বপূর্ণ বিষয় সম্পর্কে কোনো বই বা রচনা না থাকার কারণে ইচ্ছা থাকলেও অনেকে ইসলাম সম্পর্কে পড়াশোনা করতে পারে না। বাংলা ভাষায় ইসলাম প্রচারের কাজে মনোনিবেশ করা এখন যুগের একান্ত চাহিদা। প্রত্যেক নবী তার সময়ের ভাষায় ধর্ম প্রচার করেছেন। আমাদের দেশে আমাদের এই সময় যদি কোনো নবীর আগমন ঘটত, অবশ্যই তিনি হতেন বাংলাভাষী। বাংলা হতো তাঁর ভাষা। যেহেতু নবী বা রাসূল আর আসবেন না, তাই নবী-রাসূলদের যারা উত্তরসূরি রয়েছেন তাদের উচিত বাংলা ভাষায় ইসলাম প্রচারের কাজে এগিয়ে আসা।

প্রতিটি মুসলমানের ধর্মীয় অনুভূতি ও বিশ্বাসের সাথে স্বাধীনতা, স্বদেশপ্রেম ও মাতৃভাষার প্রতি ভালোবাসা বিদ্যমান। এ ক্ষেত্রে ধর্মবিশ্বাসের পার্থক্য কোনো বিভেদ বা বিরূপ মনোভাব সৃষ্টি করে না। তাই মুসলিম নাগরিকরা সবসময় মা, মাতৃভূমি ও মাতৃভাষার প্রতি ভালোবাসার চরম পরাকাষ্ঠা প্রদর্শন করেছেন। ইসলাম সব ভাষাকে সম্মান করতে শেখায়। কিন্তু ইসলামের নামে স্বাধীন হওয়া রাষ্ট্রে, পাকিস্তানের শাসকগোষ্ঠী জনমতের বিপরীতে অবস্থান করেছিল, ধর্মীয় চেতনার তোয়াক্কা না করে এ দেশের মানুষকে ভিনদেশী ভাষার পরাধীনতার শৃঙ্খলে আবদ্ধ করতে চেয়েছিল; কিন্তু এ দেশের জনগণ তা মানতে অস্বীকৃতি জানায়।

১৯৫২ সালের ২১ ফেব্রুয়ারি মাতৃভাষার মর্যাদা রক্ষার জন্য বাকস্বাধীনতা ও নিজ ভাষায় কথা বলার অধিকারের জন্য প্রাণ দেয় নিরস্ত্র ছাত্র-জনতা। পৃথিবীর ইতিহাসে একমাত্র আমরাই মাতৃভাষার জন্য রক্ত ও জীবন দিয়েছি।
আমাদের মাতৃভাষা বাংলা। আমাদের ভাষার রয়েছে এক রক্তমাখা ইতিহাস। তাই শুদ্ধ বাংলা শেখা ও শেখানো এবং বলায়-লেখায় শুদ্ধ বাংলার ব্যবহার অত্যন্ত জরুরি। এ ব্যাপারে সর্বস্তরের মানুষের সচেতনতা প্রয়োজন। কারণ, শুদ্ধ ভাষা ব্যবহারও রাসূলুল্লাহ সা:-এর অনুপম সুন্নত।

লেখক : শিক্ষার্থী, জামিয়া হোসাইনিয়া ইসলামিয়া আরজাবাদ, ঢাকা

রিপ্লাই করুন

Your email address will not be published.