দখলমুক্ত হলো “প্রস্তাবিত” বাঁকখালী নদী বন্দর
গোলাম আজম খান,
অবশেষে দখলমুক্ত হলো প্রস্তাবিত কক্সবাজারের বাঁকখালী নদী বন্দর। গত মঙ্গলবার ও বুধবার দুই দিনে শহরের প্রাণ খরস্রোতা বাঁকখালী নদীর
তীরবর্তী এলাকায় অভিযান চালিয়ে অনন্ত ৩ শতাধিক একর জায়গা দখলমুক্ত করেছে প্রশাসন। গুঁড়িয়ে দেয়া হয়েছে পাঁচ শতাধিক অবৈধ স্থাপনা। অভিযানে দখলমুক্ত জায়গা বাংলাদেশ অভ্যন্তরীণ নৌ-পরিবহন কর্তৃপক্ষের (বিআইডব্লিউটিএ) কাছে বুঝিয়ে দেয়া হয়েছে।
বাংলাদেশ অভ্যন্তরীণ নৌ পরিবহন অধিদপ্তরের (বিআইডব্লিউটিএ) সহযোগিতায় চালানো অভিযানে র্যাব, পুলিশ, পরিবেশ অধিদপ্তর ও বন বিভাগের কর্মকর্তারা উপস্থিত ছিলেন। গত বুধবার সন্ধ্যায় শেষ হওয়া এ অভিযানে চারজন নির্বাহী ম্যাজিস্ট্রেট ভ্রাম্যমাণ আদালত পরিচালনা করেন। অভিযান সমাপ্তির পর কক্সবাজারের অতিরিক্ত জেলা ম্যাজিস্ট্রেট (এডিএম) মো. আবু সুফিয়ান জানান, দুই দিনের অভিযানে কাঁচা-পাকা ও ছোট-বড় অনন্ত পাঁচ শতাধিক স্থাপনা গুড়িয়ে দেয়া হয়েছে। এতে দখলমুক্ত হয়েছে অনন্ত তিন শতাধিক একর জায়গা। খুরুশকূল-কস্তুরাঘাট সংযোগ সেতু থেকে বদর মোকাম পর্যন্ত আশপাশের এলাকায় এ উচ্ছেদ অভিযান চালানো হয়েছে।
কক্সবাজার শহরের পেশকারপাড়া থেকে নূনিয়াচরা পর্যন্ত বাঁকখালী নদী তীরের প্রায় ৬শ হেক্টর ম্যানগ্রোভ উদ্ভিদের বাগান ধ্বংস করে সাম্প্রতিককালে গড়ে তোলা হয়েছে কয়েকশত পাকা স্থাপনা। এরমধ্যে রয়েছে প্রভাবশালীদের কথিত আবাসিক এলাকাও। উপকূলীয় বনবিভাগের মতে, মাত্র কয়েক বছর আগেও এই আবাসিক এলাকা ছিল প্রায় ২০৬ প্রজাতির পশু–পাখির আবাসস্থল। কক্সবাজার জেলা প্রশাসক কার্যালয় থেকে মাত্র ২০০ গজের মধ্যেই বাঁকখালী নদীতীরের বন নিধন করে গড়ে তোলা হয়েছে আবাসিক এলাকা।
উচ্চ আদালতের নির্দেশে এ অভিযান চালানো হয়েছে উল্লেখ করে এডিএম বলেন, ‘বাঁকখালী তীরের প্যারাবন কেটে এবং ভরাট করে শত শত একর জায়গায় নানা স্থাপনা গড়ে তোলে অবৈধ দখলদাররা। অভিযানে দখলমুক্ত জায়গা বাংলাদেশ অভ্যন্তরীণ নৌ-পরিবহন কর্তৃপক্ষের (বিআইডব্লিউটিএ) নিয়ন্ত্রণে দেয়া হয়েছে।
বাঁকখালী নদী তীরের অন্যান্য এলাকায় অবৈধ স্থাপনা নির্মাণকারী দখলদারদের নতুন করে তালিকা তৈরির কাজ চলছে বলেও জানান আবু সুফিয়ান।
অতিরিক্ত জেলা নির্বাহী ম্যাজিস্ট্রেট বলেন, বাঁকখালীর অবৈধ দখলদারদের নতুন তালিকাটি জমা দেয়ার পর ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষের নির্দেশনা অনুযায়ী আবারও উচ্ছেদ অভিযান চালানো হবে। কোনো দখলদারকে ছাড় দেয়া হবে না। তাই আগেই নদীর জায়গা দখল ছেড়ে দিয়ে নিজেদের সম্পদহানি থেকে মুক্ত থাকার পরামর্শ দেন মো. আবু সুফিয়ান।
বাংলাদেশ অভ্যন্তরীণ নৌ-পরিবহন কর্তৃপক্ষ (বিআইডব্লিউটিএ) চট্টগ্রাম আঞ্চলিক কার্যালয়ের উপপরিচালক (বন্দর ও পরিবহন বিভাগ) নয়ন শীল বলেন, ‘২০১০ সালের ৬ ফেব্রুয়ারি প্রজ্ঞাপনের মাধ্যমে সরকার বিআইডব্লিউটিএ-কে প্রস্তাবিত ‘বাঁকখালী নদী বন্দরের’ সংরক্ষক নিযুক্ত করে। প্রজ্ঞাপনে নদীর তীরের ৭২১ একর জমি সংস্থাটিকে বুঝিয়ে দেয়ার নির্দেশনা ছিলো। পরে ওই সময়ের জেলা প্রশাসনের আপত্তির কারণে ২০২০ সালের ২০ ডিসেম্বর ভূমি পুনঃ যৌথ জরিপ করা হয়।’
‘জরিপে নির্ধারিত জমি হাইকোর্ট এক রিটের প্রেক্ষিতে ২০১৬ সালে রায় ঘোষণার ৬০ দিনের মধ্যে নদী তীরের ভূমি বিআইডব্লিউটিএ-কে বুঝিয়ে দিতে নির্দেশনা দিয়েছিলো।’
নানা কারণে তা বিলম্ব হয়েছে মন্তব্য করে বিআইডব্লিউটিএর এ কর্মকর্তা বলেন, ‘এরইমধ্যে সংস্থাটির পক্ষে পিলার লাগিয়ে সীমানা নির্ধারণ করা হয়েছে।
বিআইডব্লিউটিএর উপ–পরিচালক (নদী বন্দর) নয়ন শীল বলেন, বাঁকখালী নদী রক্ষায় নদীতে অবৈধভাবে গড়ে তোলা স্থাপনাগুলো উচ্ছেদ করার নির্দেশনা ছিল সরকারের। এজন্য পর্যাপ্ত বরাদ্দও রয়েছে। কিন্তু নানা কারণে দীর্ঘদিন ধরে এসব অবৈধ স্থাপনা উচ্ছেদ করা সম্ভব হয়নি। তারপরও মঙ্গলবার জেলা প্রশাসনের সহযোগিতায় অবৈধ স্থাপনাগুলো উচ্ছেদ করা সম্ভব হয়েছে। আশা করি পর্যায়ক্রমে বাকি স্থাপনাগুলোও উচ্ছেদ করা সম্ভব হবে।
বাঁকখালী নদীর এ অবৈধ স্থাপনাগুলো উচ্ছেদ করে নদী সংরক্ষণ করতে এবং অবৈধ দখল ও দূষণ থেকে রক্ষা করে নদীকে তার পূর্বের অবস্থায় ফিরিয়ে আনতে বাংলাদেশ পরিবেশ আইনবিদ সমিতি (বেলা) ২০১৪ সালে হাইকোর্টে একটি রিট দায়ের করে। ওই মামলার প্রেক্ষিতে ২০১৪ সালে বাঁকখালী নদীর দখলদারদের একটি তালিকা তৈরি করে অবৈধ স্থাপনা উচ্ছেদ করতে নির্দেশ দেন হাইকোর্ট। একই সাথে নদীর যেকোনো অংশ বা নদীর তীর কাউকে ইজারা দেওয়া থেকে বিরত থাকার নির্দেশনা দেওয়া হয়। পাশাপাশি বাঁকখালী নদীকে কেন প্রতিবেশগত সংকটাপন্ন এলাকা হিসেবে ঘোষণা করা হবে না এবং সিএস ম্যাপ অনুযায়ী নদীর সীমানা নির্ধারণ করে অবৈধ দখলদার ও দূষণকারীর কাছ থেকে কেন নদীকে সংরক্ষণ করা হবে না– মর্মে রুল নিশি জারি করেন। পরবর্তীতে ২০১৫ সালের ৬ জানুয়ারি মামলার শুনানিকালে আদালত কক্সবাজার পৌরসভার মেয়রকে বাঁকখালী নদীতে বর্জ্য না ফেলতে নির্দেশ প্রদান করেন। একই সাথে বর্জ্য ফেলার জন্য উপযুক্ত স্থান খুঁজে বের করারও নির্দেশ দেওয়া হয়।
বাংলাদেশ পরিবেশ আইনবিদ সমিতির (বেলা) প্রধান নির্বাহী সৈয়দা রিজওয়ানা হাসান বলেন, বাঁকখালী নদী রক্ষায় উচ্চ আদালতের দেওয়া নির্দেশনা দীর্ঘদিন ধরে বাস্তবায়ন না হওয়ায় সম্প্রতি বেলার পক্ষ থেকে হাইকোর্টে কক্সবাজারের জেলা প্রশাসকসহ সংশ্লিষ্টদের বিরুদ্ধে আদালত অবমাননার আবেদন করেছি। এ আবেদনের প্রাথমিক শুনানিতে কক্সবাজার জেলা প্রশাসক বেশ কয়েকবার সময় নিয়েছেন। সর্বশেষ গত রোববার আবারও এক সপ্তাহের সময় নিয়েছেন।
উল্লেখ্য,দখলমুক্ত জায়গাসহ বাঁকখালীর কস্তুরাঘাট এলাকায় নদী বন্দর স্থাপনে নৌপরিবহন কর্তৃপক্ষের প্রস্তাবনা রয়েছে। তা মন্ত্রণালয়ের সংশ্লিষ্ট পর্যায়ে সিদ্ধান্তের অপেক্ষায়।