ওমর ফারুক হিরু,
ছোট বেলা থেকে’ই মেয়েদের মত খেলতাম বলে নানা কথা শুনতে হত। কাউকে বুঝাতে পারতামনা এই আচরণের জন্য আমি দায়ী নই। প্রকৃতিগতভাবেই আমি এমনই। অষ্টম শ্রেণীতে পড়াকালিন ক্লাসের এক সহপাটির সাথে মারপিট হয়। ওই সময় স্যারও আমার বিরুদ্ধে অভিযোগ আনে আমি কেন মেয়েদের মত? সেই থেকে আর স্কুলে যাওয়া হয়নি। এর বছর খানেক পর পাড়ার এক বিয়ের অনুষ্ঠানে মেয়ে সেজে নেচেছিলাম। পরদিন সকালে সর্দার এসে পরিবারকে জানিয়ে দিল আমাদেরকে এলাকা ছাড়তে হবে। অপরাধ, আমি মেয়ে সেজে নেচে সমাজের মুখে চুনকালি মাখিয়েছি। ওই সময় মা আমাকে খুব মেরেছিল। মারধরের এক পর্যায়ে আমার মাথা ফেটে যায়। মাথা ফেটে যাওয়ায় যতটানা কষ্ট পেয়েছিলাম তারও বেশি কষ্ট পেয়েছি রক্তের সর্ম্পকের মানুষগুলোর ব্যবহার দেখে। আমি যেন তাদের কাছে বড় অচেনা মানুষ। পরে ঘর থেকে বের হয়ে যাই। বেশি অবাক লেগেছিল তখনই ঘর থেকে বের হয়ে যাওয়ার সময় একটা মানুষও আমাকে বাধা দেয়নি। বরং তারা যেন আপদ বিদায় করল। এরপর একটা দোকানে চাকরি করি। ওখানেও থাকতে পারছিলামনা মালিকের নোংরা চরিত্রের কারণে। এরই মধ্যে ওই দোকান থেকে পালিয়ে আমার জাতের (তৃতীয় লিঙ্গ) মানুষদের সাথে চলে যাই।
এসব কথা বলছিলেন ‘বন্ধু সোশ্যাল ওয়েলফেয়ার সোসাইটি’র স্বেচ্ছাসেবক আঁখি (১৯)। আঁখির পরিবারের দেওয়া নাম মোহাম্মদ তাহের। তিনি শহরের দক্ষিণ রুমালিয়ারছড়া (৭ নাম্বার ওয়ার্ড) পিটি স্কুল এলাকার ছব্বির আহম্মদের সন্তান।
গুরু’মা হিসেবে পরিচিত তৃতীয় লিঙ্গের বৃষ্টি (৩৭) জানান, আমাদের মধ্যে গুরু’মা হলেন সম্মানজনক পদ। আজ সেই অবস্থানে আমি। নিয়ম অনুযায়ী যারা ইয়াং (তরুণ) তারা আয়-রোজগার করে গুরু’মাদের খাওয়ায়। যেমনটি আমিও করেছিলাম। আর গুরু’মা সবার অভিভাবকের দায়িত্ব পালন করেন।
বৃষ্টি শহরের আর্দশ গ্রামের বাসিন্দা আব্দুর জলিলের সন্তান। পরিবারের দেওয়া নাম শরিফুল ইসলাম। চার ভাই-বোনের মধ্যে সবার ছোট। ১৪ বছর বয়সে পরিবার থেকে তাড়িয়ে দেওয়া হয়। বর্তমানে তিনি শহরের কলাতলী বিকাশ বিল্ডিং এর বিপরীতে ইলিয়াস সদরের পাহাড়ে ৮-১০ জন তৃতীয় লিঙ্গের জনগোষ্ঠী নিয়ে অস্থায়ীভাবে পাহারাদার হিসেবে অবস্থান করছেন।
তিনি আরো জানান, ‘আমার বাবা-মা জনতেন আমি তৃতীয় লিঙ্গের। তারা আমাকে খুবই আদর করতেন। কাউকে বুঝতে দিতে চাইতেন না তাদের সন্তান তৃতীয় লিঙ্গের। আমার বোন আমাকে সাজিয়ে দিত। ওই দিনগুলো খুব ভাল ছিল। কিন্তু সেই সুখ বেশিদিন রইলনা। ১৪ বছর বয়সে একে একে বাবা-মা দুই জনকেই হারাই। তাঁরা মারা যাওয়ার পর চিত্র পাল্টে যায়। মা মারা যাওয়ার ৪ দিন পর ভাইয়েরা আমাকে ঘর থেকে বের করে দেয়। ওই মুহুত্বে ক্ষুদার জ্বালায় চটপট করলেও একমুঠো ভাত দেয়নি। সবার অভিযোগ আমার চলাফেরা কেন মেয়েদের মত? আমার কারণেই নাকি তারা সমাজে মুখ দেখাতে পারছেনা। ঘর থেকে বের হয়ে সমুদ্র পাড়ের ঝাউবাগানে এক বৃদ্ধার কাছে আশ্রয় নেই। যাকে মা’ বলে ডেকেছিলাম। কিছুদিন পর ওখান থেকেই আমি আমার দলের লোকদের কাছে চলে যাই।
ছোট বেলাতেই মা-বাবা বুঝতে পেরেছিলেন আমার ভাই-বোনরা আমাকে ঠকাবে। তাদেরকে আমার প্রাপ্য দুই গন্ডা জায়াগা বুঝিয়ে দেওয়ার নির্দেশ দিয়েছিলেন। এদিকে দীর্ঘ ১২ বছর পর ২০১৮ সালে সেই জায়গার জন্য নিজ পরিবারের কাছে গেলে পাড়ার সর্দার সহ মিলে বরাবরই আমাকে ঠকায়। সর্দার বলেন তুমি’ত হিজড়া তুমি এই সমাজে থাকতে পারবেনা। জায়গাটা আমাদের কাছে বিক্রি করে দাও। ওই জায়গার দাম ধরা হয় হয়েছিল আড়াই লাখ টাকা। তারা আমার সাথে কাগজও করেছিল। কিন্তু আজ দীর্ঘ ৫ বছরেও তারা আমাকে জায়গাও দেয়নি টাকাও দেয়নি। আমি চেয়েছিলাম অন্তত আমার দলের মানুষগুলো নিয়ে ভাড়া বাসা বা কারো জায়গায় পাহারাদার হিসেবে না থেকে একটি স্থায়ী জায়গায় বসবাস করতে। তাও হলনা।
তিনি আরো জানান, খুবই লজ্জা লাগে যখন দোকানে দোকানে গিয়ে পেটের দায়ে ১০-২০ টাকা চাঁদা করি। কত কথা শুনতে হয় এই ১০ টাকার জন্য। কেউ বলে তোরা কাজ করতে পারিসনা? মরতে পারিসনা? আমরাও বলি এতবড় শরীর নিয়ে আর ভিক্ষা করতে চাইনা। আমাদের কাজ দেন। কষ্টে করে খাব। আমি এরই মধ্যে কয়েকটা হাস-মুরগী ও ছাগল পালন শুরু করেছি। যদি ছোট্ট ঋণ বা সুযোগ পাই তাহলে আমার জনগোষ্ঠি নিয়ে হাস-মুরগীর খামার বা কৃষি কাজ করে জীবনের মান পরিবর্তন করব। আমরা কর্মসংস্থানের পাশাপাশি নিরাপদ আশ্রয়স্থান চাই। সবশেষে তিনি জানান, হাত-পা ছাড়া পঙ্গু শিশুদেরও পরিবারে জায়গা হয় কিন্তু আমাদের হয়না। তাই যেই ঘরে এমন সন্তান জন্ম নেবে তাদেরকেও যেন অন্য দশজন শিশুর মত বাচাঁর অধিকার দেওয়া হয়।
বন্ধু সোশ্যাল ওয়েলফেয়ার সোসাইটির পরিচালক (পলিসি এডভোকেসি এন্ড হিউম্যান রাইটস) ফারহানা জারিফ কানতা জানান, এই মানুষদের প্রতি সহানুভূতির জায়গাটা পরিবার থেকেই আসতে হবে। পরিবারের সচেতনতার মাধ্যমে অন্য শিশুদের মত তাদের বেড়ে উঠার অধিকার নিশ্চিত হবে। তখন’ই তারা দেশের সম্পদে পরিণত হবে। বন্ধু সোশ্যাল ওয়েলফেয়ার সোসাইটি লিঙ্গ বৈচিত্র্যময় জনগোষ্ঠীর মাঝে স্বাস্থ্য সেবা, দক্ষতা বৃদ্ধি এবং আইনি সহায়তা দিয়ে যাচ্ছে।
কক্সবাজারে প্রায় ৪ শতাধিক তৃতীয় লিঙ্গের জনগোষ্ঠী রয়েছেন। জেলার সচেতন মহল বলছেন তাদের (তৃতীয় লিঙ্গ) অবহেলা নয়, সচেতনতা ও সহযোগিতার মাধ্যমে এগিয়ে যেতে হবে। তখনই দেশ ও জাতীর সফলতা নিশ্চিত হবে।